December 4, 2024, 12:16 am
ড. আমানুর আমান, সম্পাদক, দৈনিক কুষ্টিয়া
সাকুল্যে ৩০ লাখ টাকা গচ্ছা দিয়ে দেশের তিনটি রুটে চারদিন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে কৃষিপণ্য পরিবহনের তিনটি স্পেশাল ট্রেন বাতিল করে দিয়েছে। রুট তিনটি হলো খুলনা-ঢাকা, পঞ্চগড়-ঢাকা ও রহনপুর-ঢাকা। গচ্ছার বিপরীতে একই সময়ে মধ্যে রেলওয়ে আয় করেছিল ৬ হাজার ৮ টাকা।
বিগত দশক ধরেই বাংলাদেশে কৃষিপণ্য বাজার বৈষম্যপূর্ণ। দ্রব্যটির সরবরাহ ও মূল্য চরমভাবে অস্থিতিশীল। উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে বাজার পর্যন্ত মূল্যে বিস্তর পার্থক্য ফারাক। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন দেশের বাজার ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের কারনে পণ্যের দাম নির্ধারণে স্থিরতা নেই।
কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের সূত্র মতে, দেশে বছরে গড়ে বাংলাদেশে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়ে থাকে। যেখান থেকে প্রায় ২ কোটি টনসবজি উৎপাদিত হয়ে থাকে। শীত, গ্রীষ্ম, সারাবছর চাষ হয় সবজি এবং কিছু বিদেশি জাত মিলে বাংলাদেশে প্রায় ১৪২ ধরনের সবজি চাষ হয়।
সকারের ঐ দপ্তরটি বলছে, সরবরাহ বন্টন যথাযথভাবে নিশ্চিত না হবার কারনে দেশের বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলে সবজি ঘাটতি ঘটে এবং দামের বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে অর্থনীতি ও জীবন যাপনে অনাকাঙ্খিত চাপ তৈরি করে থাকে।
এ অবস্থায় সমতা তৈরি করতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সবজি তুলে নিয়ে সরবরাহে ভারসাম্য তৈরি করতে একটি সরবরাহ চেইন প্রতিষ্ঠাকল্পে সবজি ট্রেন চালুর উদ্যোগ গ্রহন করা হয়।
দেশের বৃহৎ সবজি উৎপাদন অনচল হলো তিনটি বিভাগ নিয়ে গঠিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরের জেলাগুলো। দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা যশোর এককভাবে বছরে সারাদেশের প্রয়োজনের ৬০ শতাংশ সবজি উৎপাদন করে থাকে। এর বাইরে মেহেরপুর, সাতক্ষিরাতেও প্রচুর সবজি উৎপাদিত হয়।
এই উদ্যোগে তিনটি বিভাগে রয়েছে ২, ৮০০ কিলোমিটার রেললাইন। জেলাগুলোকে ১৬টি জোনে ভাগ করে তিনটি রুটে তিনটি ট্রেন পালাক্রমে চালানোর উদোগ নেয়া হয়। প্রতি কেজি পণ্য বহনে ঢাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করা হযেছিল ১ টাকা ৪৭ পয়সা। খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত এ ভাড়া ছিল ১ টাকা ৪৭ পয়সা, যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩৫ পয়সা, চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩০ পয়সা, ঈশ্বরদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৮ পয়সা, পার্বতীপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩৪ পয়সা, জয়পুরহাট থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩০ পয়সা, সান্তাহার থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ১৯ পয়সা, রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ১৮ পয়সা, রহনপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১ টাকা ৩০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘ট্রাক বা অন্য পরিবহনের চেয়ে ট্রেনে সবজি পরিবহনে খরচ কম। ট্রাকে যতটুকু সবজি পরিবহন করা হোক না কেন, পুরো ট্রাক ভাড়াই দিতে হয়। কিন্তু ট্রেনে যতটুকু সবজি ; ততটুকু ভাড়া।
ট্রেনগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন করা হচ্ছিল পশ্চিমাঞ্চল রেলের বাণিজ্যিক কার্যালয় রাজশাহী থেকে।
অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রেলের বিশেষ ট্রেন পরিচালনার উদ্যোগকে ইতিবাচক বলেই মনে করছিলেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পণ্য পরিবহনে যে মূল্য নিধার্রিত হয়েছিল তাও ছিল ইতিবাচক। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতায় এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা-খুলনা রুটে গত ২২ অক্টোবর, পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে ২৪ অক্টোবর এবং রহনপুর-ঢাকা রুটে ২৬ অক্টোবর এই টেট্রনগুলো করা হয়। ট্রেনগুলোতে সংযুক্ত করা হয় সাতটি লাগেজ ভ্যান, যার মধ্যে একটি ছিল রেফ্রিজারেটেড।
এরপরও কেন এই উদ্যোগটি মার খেল সেটা নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন বিশ্লেষণ করে দেখছেন। মোটাদাগে বলা হচ্ছে সবজি উৎপাদক ও সবজি ব্যবসায়ীদের অনীহার কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে উদ্যোগটি। পশ্চিম রেলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাসও কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি জানান, এত অল্প পরিবহন খরচ নির্ধারন করেও বিষয়টি কার্যকর করা যায়নি।
বলা হচ্ছে পরিকল্পনা সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ মনে করা হলেও উদ্যোগটি সফল করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করা হয়নি। যার কারনে শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি একটি অসফল ঘটনা হয়ে উঠেছে।
এ প্রতিবেদক বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন এলাকার সবজি চাষীদের সাথে কথা বলেছেন।
যশোর সদর উপজেলার ছোট হৈবতপুর গ্রামের সবজিচাষি আব্দুল বাকি বিল্লাহ জানান, ‘সারাদেশের বেশীরভাগ সবজির যোগান তো এই জেলা থেকেই যায়। ট্রেন চালু করলেই সবজি গিয়ে ট্রেনে উঠবে না। রেলওয়ের কোন প্রচারই নেই যে সাধারণ সবজি চাষীরা জানবে।
তিনি বলেন, এখানে সবজির জন্য স্টেশন নির্ধারণ খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ সেটা করেনি।
যশোর সদরের বারীনগর সাতমাইল হাটের আড়তদার আতিয়ার মল্লিক জানান, ‘সবজির স্পেশাল ট্রেনে সবজি কি কৃষক নিজে ঢাকা নিয়ে যাবে নাকি ঢাকা থেকে সবজি ব্যবসায়ীরা ট্রেনে চেপে এসে সবজি নিয়ে যাবে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ট্রেনে পণ্য পরিবহনে খরচ কমের বিষয়টি মানলেও কৃষিপণ্য উৎপাদিত স্থান থেকে স্টেশনের দূরত্ব সমস্যা সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন। একই সঙ্গে একটি পণ্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে দুইবার পরিবহন লাগছে। ট্রেনে পরিবহনের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য লোডিং-আনলোডিংয়ের খরচ রয়েছে। ঢাকা পৌঁচানোর পর পূনরায় পরিবহন রয়েছে তিনি জানান।
আড়তদার আতিয়ার মল্লিক ব্যাখ্যা দেন যে এখানে আড়ত থেকে সবজি পাঠানোর জন্য ট্রাকই ভালো ও সুবিধাজনক। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য আমাদের আড়তে দিয়ে যান। ট্রাক একদম আড়তের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা ঢাকার ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করে ট্রাক লোড করে পাঠিয়ে দিই। এতে আমাদের সুবিধা। আর স্টেশনে যাওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর, যদিও ট্রেনে মাল পাঠাতে পারলে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হব।
ব্যবসায়ী ও বাজার বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, না রেলওয়ে, না সরকারী কোন প্রতিষ্ঠান কেউই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট জড়িত হয়নি। যার কারনে এতদিন সড়ক পথে এসব পণ্য পরিবহন করে যে অভ্যস্ত প্রথা তৈরি হয়ে গেছে সেটাই প্রাধান্য পেয়েছে। রেলওয়ে ছাড়াও কৃষি সংক্রান্ত সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা কৃষি পণ্য নিয়ে কাজ করে সেসব প্রতিষ্ঠান নতুন এই উদ্যোগের অংশীদার নয়। যার কারনে উদ্যেগটি গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি
এ প্রসঙ্গে চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার সুজিত কুমার বিশ্বাস জানান, এই উদ্যোগে রেলওয়ে সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ আলোচনা করেছিল।
কথা বলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রফেসর ড. মাহবুবুল আরফিন। তিনি বলেন, এখানে পণ্য পরিবহনে ট্রেনের খরচ কম রয়েছে সঠিক। কিন্তু মাঠ থেকে পণ্য স্টেশনে নেয়া এবং নির্দ্দিষ্ট গন্তব্যে পেীঁছানোর পর সেটি বাজারে নিতে বড় ধরনের খরচের বিষয়টি উল্লেখ নেই। সেটা বড় ধরনের একটি খরচ।
তবে তিনি একেবারে বন্ধ না করে এটি স্বল্প পরিসরে চালু রাখা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন।
Leave a Reply